আমরা কথা দিয়েছিলাম, বিভিন্ন চাষের বিষয় নিয়ে সৈকতভূমি Web Page-র চাষবাস কলামে কলম ধরবেন কৃষি বিশষজ্ঞ। আপনাদের অর্থাৎ যারা কৃষি কাজের উপর নির্ভরসীল তাদের জন্যে রইল পান চাষের বিস্তারিত তথ্য। লিখেছেন ড. শুদ্ধশুচি দাস।
আর্য এবং আরবগণ পানকে (সবুজ সোনা) তাম্বুল নামে অভিহিত করত। নববর্ষ থেকে বিবাহ, পূজা-পার্বণে পান আবশ্যিক। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা থেকে জ্যোতিষ শাস্ত্রে পানের ব্যবহার। সামাজিক জীবন ছাড়াও চর্বিত উদ্দীপক খাদ্য দ্রব্য হিসেবেও পান ব্যবহার হয়।
![]() |
ড.শুদ্ধশুচি দাস |
ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে পান চাষ হলেও গুণগত মানের দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পান সেরা। এই রাজ্যের প্রায় সমস্ত জেলাতেই পান চাষ হয়। তবে, যেখানে বেলে-দোঁয়াশ মাটি রয়েছে, সেখানেই ভাল পান হয়। মাটির পিএইচ ৭ কিংবা তার বেশি দরকার।
মাটি তৈরি: পান বহুবর্ষজীবী হওয়ায় মাটি তৈরিতে সতর্কতা নিতে হয়। উঁচু জমিতে জল নিকাশির সুবন্দোবস্ত যেন থাকে। জমিকে ভাল ভাবে চাষ দিয়ে রোদ্দুরে এক মাস ফেলে রাখতে হবে। এতে মাটিতে রোগজীবাণু ও আগাছার বীজ মরে যাবে। মাটি লাঙল দিয়ে বা পাওয়ার টিলারে চাষ দিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
পানের জাতঃ সাধারণত নানা জাতের পান দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে ঢলপান বা বাংলাপান, মিঠাপান, ছাঁচিপান, লালিপান, কর্পূরীপান, গাছপান ইত্যাদি।
বরজ তৈরি: পানের বরজ তৈরির সরঞ্জাম গ্রামেই পাওয়া যায়। পাট কাঠি, হোগলার ডাঁটা পাতা, উলু ঘাস, খড়, গাছের ডাল, বাঁশ, খেজুর গাছের পাতা ইত্যাদি দিয়ে ছোট ছোট চাল বানিয়ে নিতে হয়। এর পর পান জমির চারদিকে বাঁশ দিয়ে খুঁটি পুঁতে চালগুলিকে দাঁড় করিয়ে দিতে হয়। বরজের উপরেও চালগুলি ঢেকে দিতে হয় যাতে হাওয়া, আলো না ঢুকতে পারে। না হলে পানে পোকার উপদ্রব হয়। বরজে পানের ডাঁটা হাতখানেক লম্বা হলেই বাঁশের খুঁটি দিয়ে পানের ডাঁটা বা লতাগুলিকে বেঁধে দিতে হয়। যে খুঁটি ধরে তরতরিয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে পান গাছ। এই খুঁটিগুলো বরজ তৈরির সময় বসিয়ে নিতে হবে। বরজের উচ্চতা ২ মিটার হলেই ভাল। এর কম উচ্চতা হলে বরজের ভিতর চলাফেরায় অসুবিধা হয়। একটু খরচা করে আধুনিক স্থায়ী কাঠামো বানিয়ে পান চাষ করতে পারলে ভাল হয়।
চারা রোপণ: বরজের ভিতর উত্তর দিক বরাবর ৫০-৬০ সেমি দূরত্বে লাইন করতে হয়। লাইনে ১ বোর্দো মিশ্রণ প্রতি বর্গমিটারে তিন লিটার হারে স্প্রে করে দিতে হবে। ৫-৬ দিন পর পানের ডাঁটা এনে ব্লাইটস্কে শোধন করে রিং করে ১০-১৫ সেমি দূরত্বে বসিয়ে জল দিতে হবে। এর পর মাটি ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। খুব গরমকাল বাদ দিলে সারা বছরই ডাঁটা লাগানো যায়। তবে, বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে লাগালে গাছের বাড় ভাল হয়। ৪-৫ বছরের বরজ থেকে পানের ডাঁটা বা লতা নির্বাচন করতে হয়।
চারা প্রস্তুকরণঃ পান গাছের কান্ডকে ছোট ছোট টুকরায় কেটে চারা তৈরি করতে হয়। প্রতিটি চারা লম্বায় ২৫-৩০ সেমি এবং তাতে ৩-৫টি গাঁইট (পর্ব) থাকা আবশ্যক। সাধারণত দুটি গাইট মাটির নিচে এবং একটি বা অধিক গাঁইট মাটির উপরে রাখা হয়। চারা প্রস্তুতের জন্য কমপক্ষে দুই বছর বয়সের পুরাতন এবং সুস্থ ও নীরোগ গাছ নির্বাচন করা হয়।
চারা রোপণ ও রোপণের দূরত্বঃ বর্ষা শুরুর ঠিক পরেই পানের চারা রোপণ করার উপযুক্ত সময়। চারা রোপণের পূর্বে দরকার হলে জমিতে সেচ দেওয়া আবশ্যক। যে সকল অঞ্চলে ‘ঢলে পড়া’ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি, সে সকল অঞ্চলে প্রতিষেধক হিসেবে সেচের পানির সাথে কপার সালফেট মিশিয়ে দিলে সুফল পাওয়া যায়।
পানের চারা রোপণের সময় এক চারা হতে অপর চারার দূরত্ব ২৫/৩০ সেমি রাখতে হয়। এছাড়া সারি হতে সারির দূরত্ব ৩৫/৪৫ সেমি রাখা দরকার। ২/৩ সপ্তাহের মধ্যেই পানের চারা সতেজ হয়ে ওঠে এবং ১ মাসের মধ্যে প্রথম পাতা দেখা যায়। পানের চারা একটু বড় হলেই তাকে খাড়াভাবে বর্ধিত হওয়ার জন্যে অবলম্বন দরকার এবং সেহেতু পাটকাঠি বা বাঁশের কঞ্চি পুঁতে তার সাথে পান গাছ বেধে দিতে হয়।
পরিচর্যা: পান গাছ রোগ সুবেদী বলে ঘন ঘন ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। ১০-১৫ দিন অন্তর ০.৪% ব্লাইটক্স পানের ডাঁটায় স্প্রে করতে হয়। দু’আড়াই মাসের ব্যবধানে পান গাছ বরজের মাথা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলে তাকে নামিয়ে খুঁটি বরাবর ছুঁইয়ে মাটির উপরে নিয়ে আসতে হবে এবং পানের লতাকে সুতো দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। তবে নীচের দিকের পানের পাতা যাতে মাটি না স্পর্শ করে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। নইলে রোগপোকা বাড়বে। মাঝেমধ্যে বরজে সেচ দিতে হবে। গ্রীষ্মকালে ৮-১০ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। সেচ দেওয়ার সময় গোড়ার মাটি সরে গেলে রোগপোকামুক্ত মাটি দিয়ে আবার ঢেকে দিতে হবে।
সার প্রয়োগঃ পানের জমিতে প্রতি বছর হেক্টর প্রতি ৩০-৫০ কুইন্টাল গোবর সার প্রয়োগ করতে হয়। চারা ৫/৬ পাতাওয়ালা হলেই পচা খৈল জাতীয় সার প্রয়োগ করলে গাছ সতেজ হয়ে ওঠে। হেক্টর প্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া ৩ বারে জমিতে প্রয়োগ করতে হয়। উক্ত সারের সাথে ৫০ কেজি টিএসপি ও ৫০ কেজি পটাশ সার মিশ্রিত করে প্রয়োগ করতে হয়। উক্ত সার ৩ বারে সারির উভয় পার্শ্বে ২-১ ইঞ্চি গভীরতায় প্রয়োগ করতে হয়।
পোকামাকড় ও রোগঃ যে সমস্ত পোকামাকড় পান বরজের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে তাদের মধ্যে বিটেল ডাইন বাগ, মিলিবাগ, অ্যাফিড ও মাইট বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মিলিবাগ পূর্ণাঙ্গ ও নিমফ (nymph) অবস্থায় পাতার রস চুষে পানের ক্ষতি করে। অনুমোদিত কীটনাশক মাত্রানুযায়ী প্রয়োগ করলে এ সকল পোকামাকড় দমন করা যায়।
পানের রোগ পান চাষিদের নিকট সবচেয়ে বড় সমস্যা। পান বরজে রোগের প্রাদুর্ভাব হলে যেমন উৎপাদন কমে যায় তেমনি পানের বাজার দরও হ্রাস পায়। পানের রোগের মধ্যে গোড়া পচা রোগ, ঢলে পড়া রোগ, ছাতা ধরা রোগ ও পাতার দাগ ধরা রোগ বেশি মারাত্মক। অনুমোদিত ছত্রাকনাশক মাত্রানুযায়ী প্রয়োগ করলে এ সকল রোগ দমন করা যায়।
সাথী ফসলঃ পানের সাথে অতিরিক্ত সাথী ফসল হিসেবে পান বরোজেরই পাশে লাউ, কুমড়া, করল্লা, পটল, ডাঁটা ইত্যাদির চাষও বেশ লাভজনক। এ চাষে পানের ক্ষেতে ছায়া সৃষ্টি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের উপরি রোজগারেরও সুযোগ হয়।
পান তোলা: নতুন বরজে তিন থেকে চার মাসের মাথায় পান তোলা শুরু করা যেতে পারে। পাঁচ-ছয় দিন অন্তর পাতা বোঁটা সমেত তুলতে হবে। প্রথম বছরে একটি বরজ থেকে যে পান পাতা পাওয়া যাবে, দ্বিতীয়-পঞ্চম বছরে তার অনেক বেশি মিলবে। এই ভাবে বছর ছয়েক চলবে। মোটামুটি এক বিঘা বরজে প্রতি বছর হাজার চল্লিশেক টাকা লাভ থাকে।
পরিবহণ পদ্ধতিঃ
বাঁশ ও কলাপাতা দিয়ে মোড়কে বেধে পরিবহণ করা যেতে পারে।
প্যাকেজিং: প্যাকেজিং পদ্ধতিঃ ভালো পান পাতা বাছায়ের পর তা ভেজা কাপর বা কলা পাতা দিয়ে মোড়কে সাজাতে হবে। মাঝে মাঝে জল ছিটিয়ে দিতে হবে। একটি মোড়কে ১০ হাজার এর বেশি পান রাখা ঠিক নয়।
সংরক্ষণ পদ্ধতিঃ পাতা বেশিক্ষণ সতেজ রাখার জন্য প্যাকিং করার সময় একটু জল ছিটিয়ে দিতে হবে। মোড়োকে সাজানোর পর ২-৩ দিন সংরক্ষণ করা যায়।
কৃষি বিষয়ক প্রশ্ন পাঠান এই মেল আইডি তে
saikatbhoomi@gmail.com