লকডাউনে বাড়িতে বসে আছেন ? সময় কাটছে না। বাড়ির টবে চাষ করুন চেরি টমেটো। কেমনভাবে করবেন চেরি টমেটোর চাষ ? করেইবা কেমন লাভ হতে পারে ?প্রতিবেদন পড়ার আগেই আপনার মনে এমনই সমস্ত প্রশ্ন আসতে শুরু করেছে তো ? আপনাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে কলম ধরেছেন ড. শুদ্ধশুচি দাস।
চেরি
টমেটো চেরি টমেটো এক ধরণের ছোট জাতের টমেটো। এটি দেখতে চেরি ফলের মতো তাই একে চেরি
টমেটো বলা হয়। এর নজরকাড়া সাইজ, সাথে আকর্ষণীয় রঙ, গুণাবলি যা সবার কাছে জনপ্রিয় সবজি
হিসেবে স্থান পেয়েছে।
চেরি
টমেটো চাষাবাদ শুরু চলেছে করে মেক্সিকোতে ১৫ শতাব্দীতে। ১৮০০ সালে চিলি ও পেরুতে, ১৮১৫
সালে গ্রীসে, ১৯১৯ সালে আমেরিকাতে এবং পরবর্তীতে ইসরাইলসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিশেষ
করে এশিয়ার দেশ কোরিয়া, জাপান ও থাইল্যান্ডে এর চাষাবাদ শুরু হয়। যা ধীরে ধীরে ব্যাপক
জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিভিন্ন দেশে এর রং, আকৃতি মিষ্টতা, লতার বৃদ্ধি, মৌসুমী ফলন শংকরায়নের
মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়। এর মিষ্টতা ৯-১০% হলেও আমাদের দেশে তা অনেক বেশি।
চেরি টমেটো খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি দেখতে এতটা
আকর্ষণীয় ও টুকটুকে লাল হয় তাই খাবার ডেকোরেশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত সালাদ,
জুস, সস, বিভিন্ন ধরণের রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অনেকে সৌন্দর্য চর্চায় ব্যবহার করে
থাকেন। চেরি টমেটোর পুষ্টি উপাদানঃ ফাইবার বা তন্তু – ৫% প্রোটিন – ২% কার্বোহাইড্রেট
– ১% ক্যালরি – ১% ভিটামিনঃ এ – ১৭% সি – ২১% কে – ১০% মিনারেল বা খনিজ লবণঃ পটাশিয়াম
-৭% ম্যাঙ্গানিজ – ৬% ফসফরাস – ৩% কপার – ৩% চেরি টমেটোতে অন্যান্য টমেটোর মতো গুণাবলি
থাকে। চেরি টমেটো উচ্চপুষ্টিমান সম্পন্ন একটি সবজি।
এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লাইকোপিন থাকে যা ক্যান্সারের
ঝুঁকি হ্রাস করে। চেরি টমেটো হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
ব্লাড প্রেশার কমায়, স্কিন কেয়ার করে। চেরি টমেটো কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। গর্ভবতী
মহিলাদের জন্যে চেরি টমেটো খুবই উপকারী। টমেটো সালাদ বা রস করে খেলে ত্বকের মসৃণতা
বৃদ্ধি পায়। বাচ্চাদের অল্প পরিমাণ টমেটো সালাদ করে খাওয়ালে তারা সবল ও নীরোগ থাকে।
দৈনিক চেরি টমেটো খেলে চেহারার ফ্যাকাশেত্ব কমে। ত্বক মসৃণ ও উজ্জ্বল করে। চেরি টমেটো
বিভিন্ন বিপাকীয় কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চেরি টমেটো ওজন হ্রাসে সাহায্য করে।
ত্বকের যত্নের পাশাপাশি এটি চুলকে মজবুত রাখতে সাহায্য করে। দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখে।
চেরি টমেটো দেহের রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য
করে। মেনোপজ উপসর্গগুলি হ্রাস করে।
বিভিন্ন
রঙের চেরি টমেটো আছে। লাল, হলুদ, সবুজ, কালো রঙের চেরি টমেটো খুবই জনপ্রিয়। নভেম্বর
– ডিসেম্বর বীজ রোপণ করা হয়ে থাকে।সব ধরণের মাটিতে চেরী টমেটোর চাষ করা যায়। তবে দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি বেশি
উপযোগী। সাধারণত ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গাছে টেমেটো ভাল জন্মে। তাই
ভারতবর্ষে শীতকালে চেরী টমেটো চাষের জন্য উপযুক্ত
সময়। জমি ৪ থেকে ৫ বার চাষ এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুওে করে জমি তৈরি করে নিতে হবে। বীজ
বপণের ১৫-২৫ দিন পর চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। চারা রোপণের দূরত্ব সারি থেকে সারি ৬০
সেন্টিমিটার, চারা থেকে চারার দূরত্ব ৪০ সেন্টিমিটার। নভেম্বর থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চারা রোপন করা যায়। চেরি
টমেটো অনেক ছোট হওয়ার তা বৃদ্ধি পায় খুব তাড়াতাড়ি।
এটি
ঘরের বারান্দায়, ছাদে খুব সহজে লাগানো সম্ভব। প্রথমে সুস্থ সবল চেরি টমেটোর চারা অথবা
বীজ সংগ্রহ করে নিতে হবে। এরপর ছোট টবে কিছু পরিমাণ পটিং মিক্স (কোকোপিট-৫০%, মাটি-২০%,
ভার্মিকম্পোস্ট-২০%, পার্লাইট-১০% এর মিশ্রণ) নিয়ে নিতে হবে। এরপর এতে বীজ রোপণ করতে
হবে একই দূরত্বে। এর উপর হালকা লেয়ার করে মাটি দিয়ে দিতে হবে। এরপর জল দিতে হবে। প্রায়
১৫-২০ দিনের মধ্যেই চেরি টমেটো বীজ থেকে চারা উৎপন্ন হবে। ২০ দিন পরে অন্য টবে স্থানান্তর
করতে হবে। এক গ্রাম এনপিকে এক লি. জলে মিশিয়ে গাছের পাতার উপর স্প্রে করে দিতে হবে। গাছে
সবসময় ইপসম লবণ, ডিমের খোসা দিতে হবে। গোবর বা কম্পোস্ট সার হেক্টও প্রতি ৫ থেকে ৭ টন। টিএসপি, ইউরিয়ার
পরিবর্তে ডিএপি ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি। এমওপি ২০০ থেকে ৩০০ কেজি। তবে পুরো সিজনে ৩-৪ বার
এমওপি প্রয়োগ করা ভাল।
গাছের বয়স ১৫ দিন হলে ফ্লোরা
দিতে হবে। পুণরায় ফুল ফোটার পর ফ্লোরা দিতে হবে। গাছের ১-১.৫ ফুট পর্যন্ত
কোন ডাল রাখা যাবে না।
পার্শ্বকুশিসহ মরাপাতা ছাটাই করে দিতে হবে।
যেহেতু এটি ক্লাইম্বিং টাইপ তাই মাচা করে দিতে হয়। প্রয়োজনে নিড়ানী দিতে হবে এবং মাটির
উপরিভাগ আলগা করে দিতে হবে। ফলে আলো-বাতাস প্রবেশের সুবিধাসহ মাটি রস বেশিদিন ধরে রাখতে
পারবে। ৪ থেকে ৬ বার সেচ প্রয়োজন অনুযায়ী দিতে হবে। তবে চারা লাগানোর ৩ থেকে ৪ দিন
পর হালকা এবং পরবর্তীতে প্রতি কেজি সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হবে। চেরি
টমেটোর টবকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যাতে সুর্যের আলো পরে ২-৩ ঘন্টা সকালের আর যাতে দুপুরের
কড়া রোদ যেন না পড়ে। খেয়াল রাখতে হবে যেন এতে ছায়া পড়ে। চারা
গাছের সাথে একটা লাঠি বেধে দিতে হবে। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত চেরি টমেটো সংগ্রহ
করা যায়। টমেটোর মূলত
দুটি পোকা অধিকহারে ক্ষতি করে থাকে। যথা- জাব
পোকা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। টমেটোর আগাম ধ্বসা রোগের ফলে গাছের পাতা এক সময় সম্পূর্ন
শুকিয়ে যায় ফলে ফসলের মারাত্বক ৰতি হয়। চারা লাগানোর ৭৫ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে চেরী টমেটোর
ফল সংগ্রহ করা যায় এবং এপ্রিল মাস পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। হেক্টর প্রতি ফলন ৩০ থেকে ৪০
টন পর্যন্ত হয়।